আতিকুল ইসলাম :
কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ভাই-বোন আল আমিন ও রায়হানা বেগমের দুর্নীতির সিন্ডিকেট জমির দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় জমি শ্রেণী পরিবর্তন ও কম মূল্য দেখিয়ে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ ও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে এই দুর্নীতি বাস্তবায়ন করেছেন কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার মো. শাহীন হাসান ও দলিল লেখক মাহবুব সরকার। সম্প্রতি গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতির মূল হোতা আল আমিনের দুর্নীতির একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনের ফলোআপ প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য অধিকতর তদন্তে গাজীপুর জেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসকেন্দ্রিক দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড ওই আল আমীনেরই আপন বড় বোন রায়হানা বেগম রত্নার লোমহর্ষক দুর্নীতির চিত্র সামনে আসে। আল আমিন ও রায়হানা বেগম সিন্ডিকেটের সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সংশ্লিষ্ট আরও একটি দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো।অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিযুক্ত রায়হানা বেগম (৫৩) তার নিজ নামে এবং তার আপন ছোট বোন শিপা বেগম (৪৭)-এর নামে সমহারে মালিকানা দেখিয়ে কালিগঞ্জ উপজেলার বালিগাঁও মৌজার প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যমাণের পাকা বাড়িসহ ১৪.৮৭৫ শতাংশ জমি রাজস্ব ফাাঁকি দেওয়ার জন্য অবমূল্যায়ন করে ৭০ লাখ টাকা মূল্য দেখিয়ে; ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ এবং ৪০ লাখ টাকা বাকি দেখিয়ে বায়না নামা দলিল (নম্বর ৮৯৫৬|২০২০) কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশন করেন। দেখা যায়, বায়না নামা দলিলটি ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর তারিখে সম্পাদিত ও ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর তারিখে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। জমিটিতে ২ ইউনিটের ছাদযুক্ত একতলা পাকা বাড়ি থাকলেও রাজস্ব ফাাঁকি দেওয়ার জন্য দলিলে জমিটির শ্রেণী বেআইনিভাবে পরিবর্তন করে ‘সাইল’ (কম মূল্যমাণের কৃষি জমি) বলে উল্লেখ করা হয়। দলিলটির দাতা কালিগঞ্জ উপজেলার মৈশাইর গ্রামের মৌলভী আবেদ উল্লাহ ভূঞার পুত্র মো. তৈয়বুর রহমান (৯১)।পরে বায়না নামা দলিল অনুযায়ী রায়হানা বেগম (৫৩) তার নিজ নামে এবং তার আপন ছোট বোন শিপা বেগম (৪৭)-এর নামে সমহারে মালিকানা দেখিয়ে এই জমিটি ২০২১ সালের ৩১ মার্চ কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ৩১২৩।২০২১নম্বর সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রেশন করে হস্তান্তর করে নেন। কিন্তু এবার আরও রাজস্ব ফাঁকি দিতে সাফ কবলা দলিলটিতে জমির মোট মূল্য দেখানো হয় ৪০ লাখ টাকা। এটি বায়না নামা দলিলে উল্লেখিত জমির মোট মূল্যের চেয়ে ৩০ লাখ টাকা কম।বায়না নামা দলিল ও সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময়কালে রায়হানা বেগম কালীগঞ্জ উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে মোহরার পদে কর্মরত ছিলেন।রায়হানা বেগম গংদের রাজস্ব ফাঁকি দিতে জমির অবমূল্যায়ন করে কম মূল্য দেখানো; সাফ কবলা দলিলে বায়না নামা দলিলের সূত্র ও তথ্য উল্লেখ না করা; জমির শ্রেণী পরিবর্তন; বায়না নামা দলিলের তুলনায় সাফ কবলা দলিলে কম মূল্য দেখানো ইত্যাদি দুর্নীতিতে সহায়তা করেছেন কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার মো. শাহীন হাসান ও দলিল লেখক মাহবুব সরকার। এতে স্পষ্ট যে তারা সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার বিধান লঙ্ঘন করে দণ্ডনীয় অপরাধ ও ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।এ বিষয়ে জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমানকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালে তিনি লিখেন, “আমি বর্তমানে অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত ও পারিবারিক কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। দুঃখিত ভাই, রিলেটেড অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।” তার এই প্রতিক্রিয়া বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। এই সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বারবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পরও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের এমন নির্লিপ্ততা উদ্বেগজনক।গাজীপুর নাগরিক কমিটির সভাপতি জুলীয়াস চৌধুরী বলেন, এই দুর্নীতির ভয়াবহতা শুধু কালীগঞ্জ নয়, পুরো দেশের নিবন্ধন ব্যবস্থাকেই কলুষিত করছে। জাতীয় রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যারা নিজেদের আঙুল ফুলিয়ে কলাগাছ বানায়, তারা দেশের শত্রু। এদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এদেরকে অনুসরণ করে নতুন দুর্নীতিবাজরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে—এই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অবিলম্বে তদন্ত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানান।প্রসঙ্গত: রায়হানা বেগম রত্না ১৯৯৬ সালে নকল নবিস হিসেবে কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কাজ শুরু করেন।[‘নকল নবিস’ হলো একটি চুক্তিভিত্তিক এবং অস্থায়ী প্রকৃতির কাজ। এটি সরকারি চাকরি নয়। নকল নবিস সরাসরি সরকারের কাছ থেকে বেতন পান না। একজন নকল নবিস সাধারণত নিজ খরচে দলিল কপি তৈরি করেন, এবং ব্যবহারকারী বা সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে নির্ধারিত ফি’র (সরকারি অনুমোদিত ফি) একটি অংশ পান।]নকল নবিস হিসেবে কাজ শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা, ঘুষ-দুর্নীতি আর প্রভাব বিস্তার করে আলোচনায় আসেন রায়হানা বেগম রত্না।এর পর ২০১৬ সালে রূপ-যৌবনের ঝলক দেখিয়ে কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ‘মোহরার’ পদ বাগিয়ে নিয়ে যোগদান করেন কালিয়াকৈর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। এর ৩ বছর পর ফের কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বদলী হয়ে এসে আপন ভাই আল আমিন খানকেও নকল নবিসের কাজ বাগিয়ে দেন। এবং ভাই-বোন মিলে গড়ে তোলেন সাব-রেজিস্ট্রি অফিস কেন্দ্রিক দুর্নীতির সাম্রাজ্য।২০২২ সালের অক্টোবর মাসে রায়হানা বেগম রত্নাকে অফিস সহকারি হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে টঙ্গী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে বদলি করা হলে কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে তার দুর্নীতির সাম্রাজ্য প্রায় হাত ছাড়া হয়ে যায়। এর মধ্যে রায়হানা বেগম রত্নার দুর্নীতির অন্যতম সহযোগী আল আমীনের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে তাকে আইনের হাতে তুলে না দিয়ে একপ্রকার বাঁচানোর জন্য কালিয়াকৈরে বদলি করা হয়।